বিশেষ প্রতিবেদক
ফরিদপুরের একটি সরকারি কলেজ থেকে অধ্যক্ষ হিসবে সদ্য অবসর নিয়েছেন সুমসুন্নাহার। তিনি জানান, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার নাম ছিল “লালফিতা”। অবসরের পরে পেনশনের ফাইল নিয়ে এজি অফিসের এই টেবিল ওই টেবিল দৌঁড়ানো, ঘুষ দেয়া আর মাসের পর মাস পেনশন, গ্র্যাচুয়িটি আর প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য অপেক্ষা করতো হত। লাখ লাখ ফাইল জমা হত প্রতিবছর অর্থ মন্ত্রণালয়ে। আর বাড়ত ভুক্তভোগীর সংখ্যা। তিনি ইন্টিগ্রেটেড বাজেট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম বা আইবাস++ এর মাধ্যেমে কোন হয়রানি ছাড়াই অবসর নেয়ার নেয়ার তিন মাসের মধ্যে সব সরকারি সুবিধা বুঝে পেয়েছেন। তিনি এখন নিয়মিত অসরকালীন সরকারি ভাতা পাচ্ছেন। এর জন্যে তাকে শুধু টিন আর এনআইডি দিয়ে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের জন্য নিবন্ধন করতে হয়েছে। এর জন্যে তাঁকে কাউকে এক টাকাও ঘুস দিতে হয়নি।
আইবাস++ এর ওয়েব পেজ বলছে, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে ২০১৬ থেকে আজ পর্যন্ত কোন রকম হয়রানি ৭ লাখ ৪৭ হাজার ৪৪১ জন সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারির ছাড়া অবসরকালীন বেতন ভাতা পেয়েছেন। এছাড়া প্রতিমাসে মুহূর্তেই যার যার অ্যাকাউন্টে চলে যাচ্ছে ১০ লক্ষ ৯৭ হাজার ৩৪২ জন সরকারি, আধা সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারির বেতন-বোনাস। এর আগে প্রতিটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগ থেকে আলাদা আলাদা স্যালারি শিট আসতো এজি অফিসে। সেখানে লাখ লাখ কর্মচারির বেতন ভাতা তৈরি করার এক বিশাল কর্মযজ্ঞ হত। সেই পরিশ্রম থেকে মুক্তি পেয়েছেন এজি অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীরা। এতে বাঁচছে শ্রমঘণ্টা। বাংলাদেশের অর্থবিভাগকে এই ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করতে অর্থায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বের ৮৪টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের এই অর্থব্যবস্থাটি পরিচালিত হচ্ছে। আইবাস বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়কে কম্পিউটার, ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের ব্যবহার এবং কম্পিউটার-ভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থায় সহায়তা দিচ্ছে। ওয়েব পেজের তথ্য অনুযায়ী, শুরুতে শুধু সরকারি আধা সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন বোনাস নিয়মের মধ্যে আনা শুরু করলেও বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা খাতের আর্থিক লেনদেনও করছে আইবাস ++।
ওয়েব পেজ আরও বলা হচ্ছে আইবাস++ পরিচালিত হচ্ছে, ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এফএমআইএস) আওতায়। বলা হয়, এফএমআইএস সমাধানগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে সরকারি দৈনন্দিন আর্থিক কর্মকাণ্ডের দক্ষতা এবং ইক্যুইটি উন্নত করতে পারে এবং অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা বাড়ানোর জন্য একটি দুর্দান্ত সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা হতে পারে ক্যাশলেস ট্রানজেকশন বা নোটবিহীন নগদায়ন। সব কাজ হতে পারে কাগজবিহীন। গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শ্রমঘণ্টা সাশ্রয় হতে পারে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও ডিজিটাল সমৃদ্ধি হবে। ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবে জনমানুষ। ভুলভ্রান্তির সম্ভাবনা কমে যাবে। আর ভুল হলেও সেট সহজে নির্ণয় করা যাবে। সরকারের প্রতিবছর সাশ্রয় হবে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা।
কথা বলছিলেন, গাজীপুরের জেলা সহকারী সমাজসেবা কর্মকর্তা তৌহিদুজ্জামান জানান, সরকারের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় দেয়া ভাতাগুলোও এখন আইবাস ++ এর আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের মাসিক শিক্ষা উপবৃত্তি, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ভাতা, হিজড়া জনগোষ্ঠীর ভাতা, মা ও শিশু সহায়তা ভাতা, অতিদরিদ্রদের জন্য দৈনিক ভাতা এবং দরিদ্র মায়ের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা। এখন সুবিধাভোগীর মোবাইলে, মোবাইল ফাইন্যান্সিং এর মাধ্যমে সকল ভাতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাচ্ছে।
তৌহিদুজ্জামান জানান, সরকারের সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতা গ্রহণকারীকে এখন কোথাও ঘুরতে হয় না, কাউকে ঘুষ বা বখশিশ দিতে হয় না। মাসের নির্দিষ্ট দিনে ভাতাভোগীর নগদ একাউন্টে এই ভাতা চলে আসে। শুধু তাই নয় নিবন্ধনের সময় ভাতা গ্রহণকারীকে এনআইডি ব্যবহার করতে হচ্ছে, যে কারণে জালিয়াতি করে একই ভাতা একাধিকবার নেয়া বন্ধ হয়েছে। এরমধ্যে কয়েক হাজার জালিয়াতের ভাতা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রতিমাসে আইবাস ++ এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভাতা গ্রহণকারীদের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি।
তৌহিদুজ্জামান আরও বলছিলেন, আইবাস++ এর সবচেয়ে বড় কার্যক্রম দেখা গেছে, কোভিড১৯ মহামারির সময়ে। লকডাউনে জীবন-জীবিকা বাধাগ্রস্ত হওয়াতে সরকার থেকে লাখ লাখ পরিবারকে এককালীন ভাতা থেকে শুরু করে, বিভিন্ন রকম সাহায্য-সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। এই সব কাজ, স্বয়ংক্রিয়ভাবে সুবিধাভোগীর মোবাইলে ট্রান্সফার হয়েছে। করোনা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সর্বমোট ৩৫ লক্ষ জনকে এই সিস্টেমের মাধ্যমে ভাতা দেয়া হয়েছে। ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের সুবিধাভোগীর সংখ্যা এত বেড়েছে, যে সুষ্ঠুভাবে টাকা পাঠানোর জন্যে এরই মধ্যে বিকাশ নগদ এই রকেটেরে মত আরও কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিচ্ছে আইবাস++ । পাশাপশি ব্যাংকগুলোও আইবাস++ এর সঙ্গে কাজ করছে।
নগদের হেড অব কমিউনিকেশন জাহিদুল ইসলাম সজল জানান, এখন তাদের মধ্যে প্রাক্-প্রাথমিকের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে মাসিক ৭৫ টাকা উপবৃত্তি দিচ্ছে সরকারের আইবাস ++। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া প্রত্যেক শিক্ষার্থী মাসিক ১৫০ টাকা এবং এক পরিবারে ২ জন শিক্ষার্থী থাকলে ২ জন মিলে পায় ৩০০ টাকা। এ ছাড়া কোনো পরিবারে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া একজন শিক্ষার্থী থাকলে উপবৃত্তি দেওয়া হয় মাসে ২০০ টাকা। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের মাধ্যমে ‘সমন্বিত উপবৃত্তি কর্মসূচি’র আওতায় ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। উপবৃত্তির টাকা ছাত্রছাত্রীদের মায়ের নগদ অ্যাকিাউন্টে পাঠানো হয়। প্রতিমাসে ১ লাখ ২৫ হাজার ছাত্রছাত্রী স্বয়ংক্রিয় এই সিস্টেমের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে উপবৃত্তির টাকা পেয়ে যাচ্ছে।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর টাকার ব্যবস্থাপনা, সরবরাহ, লেনদেনের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতায় যে সম্ভাবনার অপচয় হয় সেটির মূল্য প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর কেবল টাকা ছাপতেই সরকারের ৫শ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়। এছাড়া সম্প্রতি নগদের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ মিশুক জানান, তাদের করা গবেষণা বলছে, সব ক্ষেত্রে শুধু ছাপা টাকা ব্যবহারের বদলে ক্যাশলেস লেনদেন নিশ্চিত করতে পারলে, প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।